মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৫

কিছুক্ষণ থাকো না -কষ্ট নিয়ে ফিরে আসা

কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক গলে যতটা পারেন জোরে কথাগুলো বলছিলেন ৭৮ বছর বয়সী সবিতা শীল। এপারে দাঁড়ানো নাতবৌ ছবি শীলকে (২৮) আরও খানিক্ষণ ‘কাছে পেতে’ তার এই আকুলতা।

ঠাকুরগাঁওয়ের ভুল্লীর মেয়ে ছবি জানালেন, বিয়ের তিন বছর পর এই প্রথম নানি শাশুড়ির সঙ্গে তার দেখা হলো।

অনেক মানুষের ভিড় ঠেলে যতক্ষণ পারা যায় ভেজা চোখে নাতবৌয়ের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলেন সবিতা। অস্ফুট কণ্ঠে মাঝে মধ্যে যা বললেন, তার বেশিরভাগটাই হারিয়ে গেল অনেক মানুষের কলরবে।

বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন সবিতা ও ছবির মতো দুই বাংলার হাজারো মানুষ স্বজনদের সঙ্গে ক্ষণিকের সাক্ষাতের সুযোগ নিতে পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখানা সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার পাশে।

প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ বিজিবি ও বিএসএফের সম্মতিতে দুই দেশের বাঙালিরা পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া এই সাক্ষাতের সুযোগ পান। কাঁটাতারের বেড়া তাদের আলাদা করে রাখলেও আবেগ পৌঁছে যায় দেশকালের সীমানা ডিঙিয়ে।

প্রায় ১০ বছর পর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা পেয়ে সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়নের লাঙ্গলগাঁও গ্রামের শরিফা খাতুনের (৬৫) চোখে আনন্দাশ্রু যেন বাঁধ মানছিল না। ভাই করিম মণ্ডল (৬০) থাকেন ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার রায়গঞ্জ থানায়।

শরিফা খাতুন জানান, অভিমানে এতদিন তাদের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু রক্তের টান ঠিকই তাদের হাজির করেছে কাঁটাতারের দুই পারে।

এখানে এসে রায়গঞ্জের প্রধান পাড়ার স্কুলছাত্র সপিজ মিয়া তার ‘বড় আব্বার’ (বাবার বড় ভাই) দেখা পেয়েছে। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়ার কারণে তার আর চাচার কোলে ওঠা হয়নি।  

সীমান্তের ৭৪৪ নম্বর পিলারের ১ থেকে ৭ নম্বর সাব পিলার পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়ার দুই পাশে এদিন নেমেছিল হাজারো মানুষের ঢল। কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়েই চলে তাদের ভাবের আদান-প্রদান।

দেখা গেল, প্রায় সবাই সঙ্গে করে কিছু না কিছু উপহার এনেছেন। বেড়ার ওপর দিয়ে সেই উপহার তারা ছুড়ে দিচ্ছেন প্রিয়জনের দিকে।

বাংলাদেশের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারি এবং ভারতের জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, কলকাতাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে সাইকেল, ভ্যান, অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, মিনিবাসে করে খুব সকালে তারা হাজির হন সীমান্তে। এরপর চলে প্রতীক্ষার প্রহর।

বিজিবি ও বিএসএফের সবুজ সংকেতে সকাল সাড়ে ১০টায় সেই অপেক্ষার অবসান ঘটে। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চলে এ মিলন মেলা।

স্থানীয়রা জানান, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে পঞ্চগড়সহ চারটি উপজেলা ভারতের জলপাইগুড়ির অধীনে ছিল। বিভক্তির পর সীমান্তবর্তী এ এলাকার অনেকেই আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

সত্তরের দশকেও এ সীমান্ত দিয়ে তারা প্রায় বিনা বাধায় আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারতেন। আশির দশকে কাঁটাতারের বেড়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়। বহু বছর পর বিজিবি-বিএসএফের সম্মতিতে নববর্ষের দিনে আবার স্বজনদের দেখা পাওয়ার সুযোগ হয় তাদের।

পঞ্চগড় ১৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আরিফুল হক বলেন, “শুরুতে বিএসএফ সম্মত ছিল না। তবে ভারতীয় নাগরিকদের চাপে তারাও কাঁটাতারের বেড়ার কাছে আসার অনুমতি দেয়। দুই পাশেই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা থাকে। নির্ধারিত সময়ের পর সবাই যে যার গন্তব্যে চলে যায়।”

অমরখানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামান বলেন, “আবেগ আর ভালোবাসার শক্তি যে কত গভীর তা এখানে এলে টের পাওয়া যাবে। দুই চার ঘণ্টায় হাজার হাজার মানুষ তাদের আবেগ-অনুভূতি ভাগ করে নিচ্ছে। তাদের আরও একটু বেশি সময় দিলে কারও তো কোনো ক্ষতি নেই।”